তাওহীদুল ইসলাম নূরী

আমি আজ এমন একটি দিন নিয়ে লিখতে বসেছি যেদিন যুদ্ধ হয়েছিল সত্যের সাথে মিথ্যার, ন্যায়ের সাথে অন্যায়ের,মুসলিম-মুমিনের সাথে কাফের-মুশরিকের। যে দিনটি প্রাধান্য পেয়েছে মহাগ্রন্থ আল কোরআনে। হ্যাঁ,আমি আজ লিখতে বসেছি ৬২৪ খ্রিষ্টাব্দের মাহে রমজানের ১৭ তারিখ বদরের মাঠে হওয়া ইসলামের ইতিহাসে প্রথম প্রকাশ্য জিহাদ “বদর যুদ্ধ” নিয়ে। যে যুদ্ধ মুসলিম-মুশরেক উভয়কেই উত্তম শিক্ষা দিয়েছিল। কারণঃ- বদর যুদ্ধ সংঘটিত হওয়ার বেশ কিছু কারণ ইতিহাসে পাওয়া যায়। মদিনায় ইসলামের ক্ষমতা এবং প্রভুত্ব দেখে কাফের গোষ্ঠীর টনক নড়ে। তারা মদিনা বিজয়ের পর থেকেই ভেবেছিল রাসূল (সঃ) এর নির্দেশে মুসলমানেরা তাদের ব্যবসায়-বাণিজ্যসহ গুরুত্বপূর্ণ সকল ক্ষেত্রেই বাধা দেবে এবং মদিনাবাসীর মতো তাদেরকেও রাসূল (সঃ) এর প্রভুত্ব স্বীকার করতে হবে। এজন্য তারা সুগভীর ষড়যন্ত্রে মেতে উঠে। হিজরতের পূর্বে মদিনার বনু খাখবাজ বংশের আব্দুল্লাহ বিন উবাই বিন সুসুল নামক এক ব্যক্তির মদিনার শাসক হওয়ার কথা ছিল। কিন্তু বিশ্বনবী সেখানে প্রত্যাবর্তন করলে যখন সমস্ত মদিনাবাসী একযোগ তাঁকে (রাসুলকে) শাসনের চেয়ারে বসাল, তখন হাজার মনোবেদনা সত্বেও আর দশজনের মতো এই লোকটিও বিশ্বনবীকে মেনে নেয়। কিন্তু গোপনে ষড়যন্ত্র চালাতে থাকে। আর তাকেই কোরাইশেরা ষড়যন্ত্রের ঢাল হিসেবে ব্যবহার করে। মূলত যে ঘটনাকে কেন্দ্র করে বদর যুদ্ধ সংঘঠিত হওয়ার চূড়ান্তরূপ নিয়েছল সেটি হল- ইসলামের ইতিহাসে প্রথম শত্রু আবু সুফিয়ান (পরবর্তীতে মুসলমান) অস্ত্র সংগ্রহের জন্য বাণিজ্যের অজুহাতে একটি কাফেলা নিয়ে সিরিয়া গিয়েছিল। এ কাফেলায় ৫০,০০০ দিনার মূল্যের ধণরত্ন ছিল। নাখলার নামক এক যুদ্ধে এ বাহিনী বিপর্যস্ত হয়ে ফিরতে দেরী হলে জনরব হয়ে উঠে যে, মুসলিম বাহিনী আবু সুফিয়ান এবং তার বাহিনীকে ধরাশয়ী করেছে এবং আবু সুফিয়ান এতে নিহত হয়েছে। এ জনরবের সত্যতা যাচাই না করে আক্রমণাত্মক নীতিকে প্রাধান্য দিয়ে আবু জেহেল এক হাজার সৈন্য নিয়ে মদিনা অভিমুখে যুদ্ধ করতে রওনা হন। পথিমধ্যে যদিও সত্যিটা জানতে পায় তবুও আবু জেহেল পিছ পা না হয়ে সামনে অগ্রসর হয়।যদিও আখনাস ইবনে শোরাইকসহ অনেক কাফের নেতা ফিরে যাওয়ার প্রস্তাব দিয়েছিল, কিন্তু আবু জেহেল দাম্ভিকতার সাথে তা প্রত্যাহার করে সামনে চলল। মুসলমানদের যুদ্ধ প্রস্তুতিঃ- কোরাইশদের সম্পর্কে অবহিত হওয়ার পর রাসূল (সঃ) সকল সাহাবীকে একত্র করে ঘটনা বৃত্তান্ত করলেন। হযরত আবু বকর (রঃ) এর প্রোণোৎসর্গী বক্তৃতা উপস্থিতদের মাঝে শিহরণ সৃষ্টি করল। আনসারগণ এই মর্মে বাইয়াত গ্রহণ করেছিল যে, কোন দুশমন যদি মদিনা আক্রমণ করে তারা অস্ত্র ধারণ করবে। তাই রাসূল (সঃ) তাদের দিকে তাকালেন। তাদের মধ্যে হতে খাখরাজ গোত্রের নেতা হযরত সায়াদ বন ওবাদা (রঃ) দাঁড়িয়ে বললেন “আপনার ইশারা আমাদের প্রতি নিবেদিত, আপনি বললে আমরা সমুদ্রেও ঝাঁপিয়ে পড়তে পারি।” হযরত মেকদাদ (রঃ) ও বললেন ”আমরা মুসার উম্মতের মত বলব না যে, আপনি এবং আপনার প্রতিপালক যুদ্ধ করেন। আমরা বসে থাকব, বরং আমরা আপনার সাথে থেকে ডানে-বাঁয়ে, সামনে-পিছনে কঠোর সংগ্রাম করে বিজয় সুনিশ্চিত করব।” এর পর আল্লাহর হাবীব প্রায় তিনশত তের জন সৈন্য নিয়ে বদরের দিকে রওনা হন। কোরাইশদের যুদ্ধ প্রস্তুতিঃ- কোরাইশরাও অত্যন্ত বিচক্ষণতা নিয়ে সৈন্যবাহিনী গঠন করে এবং প্রায়সব গোত্র ও আবু লাহাব ছাড়া প্রায়সব গোত্রের নেতারা এতে অংশ নিয়েছিল। খাদ্যসহ নানা কিছুর দায়িত্ব এক এক গোত্রকে ভাগ করে দেয়া হয়েছিল। তারা প্রায় এক হাজার সৈন্য নিয়ে বদর অভিমুখে রওনা দেয়। উল্লেখ্য, পথিমধ্যে নানা মতবিরোধের কারণে বনু আদি গোত্র যুদ্ধে অংশ না নিয়ে ফিরে যায়। যুদ্ধের আগের রাতঃ- কাল শুরু হবে তুমুল যুদ্ধ। মুসলিম-মুশরিক উভয়ের মধ্যেই চলছে নানা জল্পনা-কল্পনা। বিশ্বনবী এবার বদরের মাঠে তাঁবু পেতে সাহাবা কেরামের মাঝে যুদ্ধের তাৎপর্য ও গুরুত্ব আলোচনা করতে লাগলেন। আলোচনার পর বিশ্বনবী আল্লাহর দরবারে হাত তুলে অতি কাতরতার সহিত বলতে লাগলেন, “হে আল্লাহ! আমাদের এ কাফেলা যদি নিপাত যায়, তাহলে কিয়ামত পর্যন্ত তোমার এবাদত করার মতো কেউ থাকবে না। হে আল্লাহ! তুমি কি চাও আজকের পর থেকে তোমার কেউ নাম না নিক?” তিনি এমনভাবে মুনাজাত করছিলেন যে, তার স্কন্দেশ হতে বার বার চাদর পড়ে যাচ্ছিল আর হযরত আবু বকর (রঃ) তা তুলে দিচ্ছিলেন এবং বলছিলেন ‘হে রাসূল আপনি থামুন। নিশ্চই আল্লাহ আপনাকে সহযোগিতা করবেন। জবাবে বিজয়ের সংবাদ দিয়ে আল্লাহও বললেন, “নিশ্চই আমি তোমাকে সাহায্য করব এক হাজার ফেরেশতা দ্বারা, যারা একের পর এক আসবে।” (সূরা আনফাল) যুদ্ধের দিনঃ-সকালে উঠে বিশ্বনবী সাহাবীদের নিয়ে বদরের মাঠ পরিদর্শন করেন এবং বিভিন্ন স্থানের দিকে নির্দেশ দিয়ে বলেন এ স্থানে অমুক কাফের, ঐ স্থানে অমুক কাফের নিহত হবে। হযরত উমর ফারুক (রঃ) এর বর্ণনা ”ঐ আল্লাহর কসম, যিনি রাসূল (সঃ) কে সত্য দ্বীনসহ প্রেরণ করেছেন। রাসূল (সঃ) তার ভবিষ্যৎ বাণীতে বদরের প্রান্তরে কাফেরদের মৃত্যু সম্পর্কিত যে যে স্থানই নির্দেশ করছিলেন তারা ঠিক সেই সেই স্থানেই মৃত্যুবরণ করেছে। কোন কাফেরই রাসূল (সঃ) এর নির্দেশিত স্থান ছাড়া অন্য কোথাও মৃত্যুবরণ করে নাই। সত্যের সাথে মিথ্যার, ন্যায়ের সাথে অন্যায়ের, হালালের সাথে হারামের শুরু হল তুমুল যুদ্ধ। উমরের তলোয়ার মামার রক্তে রঞ্জিত হল। এমন ঘটনা আর কত কি। যখনই কে যেন সাদা পোষাকে একদল সৈন্য এসেছেন এমন বললেন সাথে সাথেই রাসূল (সঃ) বললেন “জিব্রাঈলের নেতৃত্বে ফেরেশতারা আমাদের সাহায্যের জন্য এসেছেন”। বিরাট কাফের বাহিনী মাত্র তিনশত তের জন মুসলিম সেনার হাতে ধরাশায়ী হলেন। প্রথমেই উতবা শায়বা এবং ওয়ালিদের মৃত্যু দেখে আবু জেহেল বিধর্মী বাহিনীসহ ঝাপিয়ে পড়ে। কিন্তু পরক্ষণেই মুয়াজ এবং মুয়িজ নামে দুই সহোদরের হাতে নিহত হন এ পাপিষ্ঠ। “হয় আবু জেহেলকে মারব,নয় নিজেরাই মরব” এ প্রতিজ্ঞা নিয়েই এরা তার উপর ঝাপিয়ে পড়ে তাকে ধরাশয়ী করে। যুদ্ধের ফলাফলঃ- বদর যুদ্ধে কোরাইশদের সত্তর জন কাফের নিহত হন এবং সত্তর জন মুসলমানদের হাতে বন্দি হন। অন্যদিকে মাত্র চৌদ্দ জন সাহাবী শাহাদৎ বরণ করেন। তাদের মধ্যে একজনের চিত্র তুলে ধরা হল তার নাম ছিল ওমায়ের ইবনে হাম্মাম। রাসূল (সঃ) যখন বদরের পথে “আমার সাথে জান্নাতে চল” বলে যাচ্ছিলেন তখন তিনি খেজুর খাচ্ছিলেন। তিনি তৎক্ষণাৎ রাসূল (সঃ) কে জিজ্ঞেস করলেন “ইয়া রাসূলুল্লাহ আমি কি সেখানে গেলেই জান্নাতি হব না কি?” জিজ্ঞেস করলে উত্তরে আল্লাহর হাবীব যখন “মরলেও জান্নাতি বাঁচলেও জান্নাতি” বলেন তখন তিনি খেজুরগুলো ফেলে দিয়ে বদরের জিহাদে শামিল হন।এবং সেখানে গিয়ে অসংখ্য কাফের মেরে নিজেও শহীদ হন। কোরাইশদের হা-হা-কা-রঃ- বদরের শোচনীয় পরাজয়ের সংবাদ সমস্থ মক্কায় কান্না সৃষ্টি করে। সমস্থ জায়গাতেই নিরব শোক আর শোক। কয়েকজন কাফের মিলে শোক সভার আয়োজন করতে চাইলে মুসলমানেরা হাসবে ভেবে অন্যরা তাতে বাধা দেয়। আবু লাহাব এতটা শোকাহত হয়েছিল যে,সে এমনভাবে শয্যা গ্রহণ করেছিল যে, সাতদিন পর সেখানেই প্লেগ রোগে আক্রান্ত হয়ে মারা গেল। প্লেগ আরবের মাঝে একধরনের বিষাক্ত রোগ। প্লেগ রোগে মারা যাওয়ায় কেউ তার পাশে আসল না। অবশেষে, লোকে কিছু বলবে ভেবে অনিচ্ছা সত্ত্বেও তিনদিন পর তার সন্তানেরা একটি গর্ত করে সেখানে ফেলে দিল। আবু সুফিয়ান বলল এ পরাজয়ের গ্লানি যতদিন শোধ করতে পারব না, ততদিন হয় সুগন্ধি ব্যবহার করব না নয় স্ত্রী স্পর্শ করব না। আবু জেহেলের দু-পুত্রসহ অনেকেই তার পাশে এসে দাঁড়ালো। কাব ইবনে আশরাফ প্রমুখ ইয়াহুদির কবিতা তাদের আন্দোলিত করল। বদর যুদ্ধের শিক্ষাঃ- বদর যুদ্ধ আমাদের উপর অনেক শিক্ষা বর্তায়। শুধু সংখ্যাধিক্যই যে, যুদ্ধ জয়ের কারণ নয় বরং আল্লাহর পথে থাকলে অল্পতেও যে, আল্লাহ বিজয় দেন বদরের প্রান্তর তার উৎকৃষ্ট প্রমাণ। তাই ইসলামের পক্ষের সংখ্যা আমরা যারা আছি সংখ্যার দিকে না গিয়ে বরং ঈমানের দিকে তাকিয়ে আমাদের সামনের দিকে অগ্রসর হতে হবে। এ প্রেরণা বক্ষে ধারণ করতে হবে যে, যে ইসলাম প্রতিষ্ঠার জন্য বদরের যুদ্ধ হয়েছিল। সেই ইসলাম আমাদের জান, মাল দিয়ে প্রয়োজনে জিহাদ করে রক্ষা করতে হবে। আল্লাহ আমাদের সকলকে এ কাফেলার জন্য কবুল করে জান্নাতি হওয়ার তৌফিক দান করুন ’আমিন”। মাআসসালাম

তাওহীদুল ইসলাম নূরী, আইন বিভাগ (অধ্যয়নরত), আন্তর্জাতিক ইসলামী বিশ্ববিদ্যালয় চট্টগ্রাম। শাহারবিল সদর, চকরিয়া, কক্সবাজার।